চলতি বছর কুয়াকাটা সৈকতে বিশটি মৃত ডলফিন ভেসে এসেছে। সর্বশেষ গত ৯ সেপ্টেম্বর সকালে সৈকতের জিরো পয়েন্ট সংলগ্ন সানসেট পয়েন্টে একটি মৃত ডলফিন ভেসে আসে। শুধু আগস্ট মাসেই কুয়াকাটায় দশটি মৃত ডলফিন ভেসে এসেছে। গত বছর কুয়াকাটা উপকূলে আটটি মৃত ডলফিন ভেসে এসেছিল। তবে এসব ডলফিন কেন মারা যাচ্ছে তা বলতে পারছেন না কেউ।
কুয়াকাটা ডলফিন সংরক্ষণ কমিটির সদস্য কে এম বাচ্চু বলেন, ‘গত ২১ আগস্ট দুপুরের দিকে কুয়াকাটা সৈকতে জোয়ারে পানির সঙ্গে ডলফিন ভেসে আসে। ২০ আগস্ট দুটি ডলফিন ও প্রায় বিলুপ্ত প্রজাতির একটি রাজ কাকড়া উপকূলে ভেসে এসেছিল। ৯ আগস্ট দুটি, ৮ আগস্ট একটি, ৭ আগস্ট একটি ডলফিন কুয়াকাটা সৈকতের তীরে ভেসে এসেছিল। সেগুলোকে মাটি চাপা দিয়েছি।’
স্থানীয় জেলে আশরাফ আলী জানান, ২০ আগস্ট একই প্রজাতির দুটি মৃত ডলফিন কুয়াকাটা সৈকতের তীরে ভেসে এসেছিল। এর একটির মুখে জাল পেঁচানো এবং অপটির শরীরে একাধিক আঘাতের চিহ্ন ছিল। ২১ আগস্ট ভেসে আসা ডলফিনটির গায়ে জাল পেঁচানো ছিল। এ যাবৎ কুয়াকাটা সৈকতের তীরে যত মৃত ডলফিন এসেছে সবগুলোর শরীরে কমবেশি আঘাতের চিহ্ন ছিল।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রত্যক্ষদর্শী একজন জেলে বলেন, ‘অধিকাংশ সময় দেখা যায় ডলফিনগুলো সাগরে দলবদ্ধভাবে চলাফেরা করে। কিছু দিন আগে সাগরে আমাদের জালে পাশাপাশি দুটি ডলফিন আটকে যায়। ওদের গায়ে অনেক শক্তি, পুরো জালই মুড়িয়ে নষ্ট করার চেষ্টা করছিল। এজন্য আমরা দ্রুত জাল কেটে দেওয়ার পরে চলে গেছে। তারপরে কী হয়েছে জানি না। ডলফিন দুটি অনেক জাল ছিঁড়ে ফেলেছিল সেদিন।’
কুয়াকাটা ডলফিন রক্ষা কমিটির দলনেতা রুমান ইমতিয়াজ বলেন, ‘একের পর এক ডলফিন মারা যাওয়ায় আমরা উদ্বিগ্ন। কয়েক মাস ধরেই মৃত ডলফিন ভেসে আসছে কুয়াকাটা সৈকতের তীরে। আমরা ডলফিনের মৃতদেহ উদ্ধার করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। সমুদ্রের বন্ধুপ্রাণী ডলফিন রক্ষায় কী করা যায়, তা নিয়ে ভাবার জন্য সংশ্লিষ্ট দফতরকে অনুরোধ জানাচ্ছি।’
তিনি আরও বলেন, ‘জেলেদের জালে ডলফিন আটকা পড়লে তারা মনে করেন, এটি হিংস্র প্রাণী। কিন্তু ডলফিন সমুদ্রের একটি বন্ধুপ্রাণী। এখন অতি জরুরি, জেলেদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে ডলফিন সম্পর্কে অবগত করা। এতে কিছুটা হলেও ডলফিনের মৃত্যু কমে আসবে।’
ওয়াইল্ডলাইফ কনজারভেশন সোসাইটি অব বাংলাদেশের মতে, মাছ ধরার জালে, বিশেষ করে কারেন্ট জালে ধরা পড়ার কারণে বেশিরভাগ ডলফিন মারা গেছে। বিপন্ন প্রজাতির ইরাবতী ডলফিন সুন্দরবনের নদীতে এবং বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলার পার্শ্ববর্তী পায়রা, বিষখালী ও বলেশ্বর নদীতে বাস করে।
ওয়াইল্ডফিশ অ্যান্ড হ্যান্সড কোস্টাল ফিশারিজ ইন বাংলাদেশ (ইকো ফিশ-২) অ্যাক্টিভিটির পটুয়াখালী জেলার সহযোগী গবেষক সাগরিকা স্মৃতি বলেন, ‘মৃত ডলফিনের অন্ত্রের একটি অংশ ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাগারে এবং অপর অংশ বন অধিদফতরে পরীক্ষাগারে পাঠানো হচ্ছে। পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর ডলফিনটির মারা যাওয়ার প্রকৃত কারণ জানা যাবে।’
কলাপাড়া উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা অপু সাহা বলেন, ‘ডলফিনের মৃত্যুর কারণ তদন্তে যে ধরনের মেডিক্যাল যন্ত্রপাতি ও লোকবল থাকা দরকার তা আমাদের নেই। এ কারণে ডলফিনগুলো মাটিচাপা দিতে বলা হচ্ছে। আর ডলফিন কেউ মেরে ফেললে বন্য আইনে বিচার হবে। এ দায়িত্ব বন বিভাগের।’ সাগরে বাঁধা জালের ব্যবহার বেড়ে যাওয়ায় এ বছর বেশি ডলফিন মারা যাচ্ছে বলে ধারণা করছেন তিনি।
এ বিষয়ে পটুয়াখালী জেলা বন কর্মকর্তা মো. তারিকুল ইসলাম বলেন, ‘এসব ডলফিনের মৃত্যুর সঠিক কারণ এখনও আমাদের অজানা। ডলফিন মারা যাওয়ার বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে। ইতোমধ্যে ডলফিন মৃত্যুর রহস্য উদঘাটনে নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়েছে। রিপোর্ট পাওয়া গেলে কারণ জানা যাবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘ডলফিন হত্যা করলে বন আইনে বিভিন্ন মেয়াদে সাজার বিধান রয়েছে। কিন্তু কে এই ডলফিন শিকার বা হত্যা করেছে, কীভাবে করেছে ও কোথায় করেছে তার সুনির্দিষ্ট তথ্য জানা নেই। এ কারণে আমরা কাউকে আইনের আওতায় আনতে পারছি না। আমরা জেলেদের নিয়ে সচেতনতামূলক সভার আয়োজন করেছি। এতে ডলফিনের মৃত্যু কমে আসতে পারে।’
পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিশারিজ টেকনোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান ড. মো. সাজেদুল হক বলেন, ‘ডলফিনের মৃত্যু খবর পেয়ে আমরা পরিদর্শনে গিয়েছিলাম। সেখানে গিয়ে যে ডলফিনটি দেখতে পেয়েছি, সেটি আঘাত পেয়ে মারা গেছে। এভাবে ডলফিনের মৃত্যু হতে থাকলে পরিবেশের ওপর খারাপ প্রভাব পড়বে।’ এসব ডলফিন নদীদূষণ এবং আঘাত পাওয়ার কারণে মারা যাচ্ছে বলে দাবি করেন তিনি।
ওয়াইল্ডলাইফ কনজারভেশন সোসাইটি অব বাংলাদেশের তথ্যমতে, ২০১৬ সাল থেকে ২০১৯ সালের অক্টোবর পর্যন্ত বাংলাদেশে ১৪৯টি ডলফিনের মৃত্যু হয়েছে।
সূত্র: বাংলা ট্রিবিউন
No comments:
Post a Comment